অণুগল্প : জীবন মৃত্যু
লিখেছেন লিখেছেন আমীর আজম ১২ জুন, ২০১৮, ০২:০৮:১৮ রাত
ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে রাস্তায় হাটছে ডা. তমাল। উৎসুক জনতা তাকিয়ে আছে তার দিকে। স্যুট কোট পড়া একজন ডাক্তার এভাবে বৃষ্টিতে ভিজবে, এটা যেন কিছুতেই মানতে পারছে না তারা।
.
হুমায়ুন আহমেদের হিমু টাইপের কেউ হলে হয়তো বিষয়টা মানা যেত। গায়ে থাকবে হলুদ পাঞ্জাবি। পা জুতা বিহীন। বৃষ্টিতে ভিজে চলছে উদ্দেশ্যহীন।
.
ডা. সাহেবের অবশ্য এইদিকে কোন মনোযোগ নেই। এমনকি পকেটে মানিব্যাগ, দামী মোবাইলটা ভিজে যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেদিকেও ভ্রুক্ষেপ নেই।
.
তার মন পড়ে আছে হাসপাতালে।
**********
হাসপাতালের বেড। মা ও ছেলে একসাথে বসে আছে। মায়ের বয়স ৪০-৪৫ আর ছেলেটার হবে ১৫-১৬। মা ছেলেকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে আর কি নিয়ে জানি গল্পগুজব করছে। মজাদার কোন বিষয় হবে হয়তো। কিছুক্ষণ পরপরেই তাদের হাসির শব্দ পুরো ওয়ার্ডে ছড়িয়ে পড়ছে।
.
সেদিকে তাকিয়ে আছে ডা. তমাল। তাদের হাসি।দেখে তারও হাসার কথা ছিল। কিন্তু পারছে না। কি নিখুঁত অভিনয় করে যাচ্ছে মা ও ছেলে দুজনেই।
.
ডা. তমাল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক উপজেলা সদর হাসপাতালে পোস্টিং হয়েছে। হাসপাতালে অনেক সীমাবদ্ধতা। রোগীদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করার কোন ব্যবস্থা নেই। পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। দালালদের দৌরাত্ম্য।
.
আর রোগীরাও জানি কেমন। ডা. সাহেব যা বলবে তার উল্টাটা করার জন্যই ব্যস্ত হয়ে থাকে। যাকে বলবে আপনার তেমন কোন সমস্যা নেই। ওষুধ দিচ্ছি, বাড়িতে গিয়ে খাবেন। সে জোরজবরদস্তি করে ভর্তি হবে। আর যাকে বলবে আপনার সমস্যাটা জটিল, কয়েকদিন ভর্তি হয়ে থাকেন। সে কিছুতেই ভর্তি হবে না। বাড়িতে যাবেই।
.
এরকম হাজারো অস্বস্তি নিয়ে চলছে তার জীবন।
**********
মায়ের সমস্যাটা জটিল। দুইটা কিডনিই নষ্ট। বড় হাসপাতালে নিতে হবে। ডায়ালাইসিস করতে হবে। অনেক ঝক্কিঝামেলার বিষয়। এত ছোট ছেলাটার পক্ষে এত কিছু সামাল দেয়া সম্ভব না। তাই গত দশদিন থেকে এ হাসপাতালেই পড়ে আছে। বলা চলে গত দশদিন থেকে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
.
মাঝে মাঝে ছেলেটা আসে। কথা বলে ডাক্তারের সাথে :
- স্যার, একটা অনুরোধ করবো?
- করো।
- মায়ের সমস্যাটার কথা মাকে বলিয়েন না।
- কেন?
- কষ্ট পাবে খুব। সারাজীবন অনেক কষ্ট করছে। এই শেষ সময়ে আর কষ্ট দিতে চাই না।
- আচ্ছা ঠিক আছে বলবো না।
.
মায়ের সাথেও কথা হয় কখনো কখনো।
- ডাক্তার সাহেব, একটা কথা বলি।
- জি বলেন।
- আমার এই অসুখটার কথা আমার ছেলেটাকে বলিয়েন না।
- কেন?
- বাপ মরা ছেলে। অনেক কষ্ট করে। এই শেষ সময়ে তার কষ্ট আর সহ্য করতে পারবো না।
- কিন্তু একদিন তো জানবেই।
- যখন মারা যাবো, তখন জানলে জানবে। আমি তো আর দেখতে পাবো না।
- আচ্ছা ঠিক আছে বলবো না।
**********
দুপুর ২:২৫ বাঁচে। ডিউটি প্রায় শেষের দিকে। ডা. তমাল ব্যাগ গোছাতে থাকে। দ্রুত বাড়ি যেতে হবে। আজকে ছোট খাটো একটা প্রোগ্রাম আছে বাড়িতে।
.
হঠাৎ শোনে বাইরে হই হট্টগোল। একটা এক্সিডেন্টের রোগী আসছে। রোড এক্সিডেন্ট।
.
রোগীর দিকে তাকাতেই ধকধক করে উঠে ডা. তমালের বুক। এ তো সেই ১৫-১৬ বছরের ছেলেটা।
তাড়াতাড়ি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে। বুঝতে পারে সময় শেষ। বেঁচে নেই।
.
ওয়ার্ডে মায়ের দিকে তাকায়। কেমন যেন ছটফট করছে। হয়তো ছেলের জন্যে অপেক্ষা করছে। কখন ওষুধ নিয়ে আসবে? কখন দুজন একসাথে ভাত খাবে?
.
চিন্তা করতে পারছে না সে। ডিউটি টাইম শেষ। ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়ে বেরিয়ে আসে হাসপাতাল থেকে।
**********
বৃষ্টিতে ভিজছে ডা. তমাল। ভাবছে। এতক্ষণে হয়তো ছেলের মৃত্যুর সংবাদ জেনে গেছে মা। মৃত্যু সংবাদ কার শোনার কথা, আর কে শুনবে? কিভাবে সহ্য করবেন তিনি?
.
কেন এরকম হয় মানুষের জীবনে? হঠাৎ মনে পড়ে যায় কালজয়ী একটা বাক্য। " জীবন মৃত্যুর ফয়সালা আসমানে হয়, জমীনে নয়। "
।
।
অণুগল্প : জীবন মৃত্যু
১২/০৬/১৮
বিষয়: বিবিধ
৬৫১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বেস্ট ছিল ভাই অসম্ভব ভাল লিখেছেন হার্ট টাচিং কাহিনি
মন্তব্য করতে লগইন করুন